খানিকটা অদ্ভুতুরে, আবার খানিকটা জীবনবোধের। এই গল্পের স্পর্শ আপনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, যা আপনি নিজে ধরতেও পারবেন না। গল্পটির প্লট খুব সোজা, একজন মানুষ চিকিৎসকের কাছে এসে দাবি করছেন, তিনি আসলে বাস্তব জগতে নেই; বরং তিনি হয়তোবা বড় কোন স্বপ্নের মধ্যে আছেন।
এই স্বপ্নের মধ্যেই তিনি ডাক্তারের কাছে এসেছেন। গল্পটা আপনাকে এই প্রশ্ন সামনে রেখে শেষ হবে যে, তিনি কি বাস্তব জগতে আছেন, নাকি সত্যি সত্যিই স্বপ্নে? গল্পে দেখা যায়, মুল চরিত্র তার চাকরি ক্ষেত্রে একটি আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নিজের নাম জড়িয়ে পরতে দেখেন, যদিও বা তিনি এসবের সঙ্গে ছিলেন না।
কোমা থেকে উঠে যেসব ঘটতে থাকে
ক্ষোভে-দুঃখে তিনি অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে কোমায় চলে যান। কোমা থেকে উঠে যেসব ঘটতে থাকে, তার ব্যাখ্যা দেওয়া খানিকটা কঠিন। যেমন, সময়ের বিভ্রান্তি- তার ছোটবেলার কোন বন্ধু তার বাসায় চলে আসছে অথচ সেই বন্ধুটি এখনও বড়ই হয়নি। স্থানের বিভ্রান্তি- পলাশি হয়ে মৎস ভবনে বাস থেকে নেমে তিনি দেখেন তিনি আসলে নাটোরের একটি রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন।
এছাড়াও তিনি অফিসে গিয়ে দেখতে পান এখানে কোন আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেইনি। তিনি ধরেই নেন, বাস্তব জগতে এমন জটিলতা সম্ভব না। এই মুহুর্তে গল্পের একটি দিক উন্মোচিত হয়।
গ্রামবাসীর কাছে এই শিশু যেন আল্লাহর রহমত
তা হলো- মুল চরিত্রে থাকা নারী কি আদৌ এখন স্বপ্ন দেখছেন? নাকি তিনি আগের একটি বড় স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে বাস্তব জগতকে চিনতে পারছেন না? গল্পের এই দিকটি খুব জোড়ালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না বেশ কিছু বিষয়ের কারণে।মিসেস প্রহেলিকা নামের এই ভিজুয়াল ফিকশনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করা হয়েছে।
যা কিছু ক্ষেত্রে চোখের আড়াল হলেও মুল গল্পকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই গল্পটি দেখানো হয়েছে শুধুমাত্র একটি কক্ষে। পুরনো দিনের সাইক্রিয়াটিস্টের চেম্বার। যেখানে আবছা আলোয় একটি ব্ল্যাকবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়।
যার মধ্যে কিছু শব্দ লেখা। বাহ্যিকভাবে এটিকে সেট ডিজাইনের অংশ হিসেবে মনে হলেও শব্দগুলোও গুরুত্ব বহন করে। যেমন বোর্ডের শেষে ইংরেজি অক্ষরে লেখা- হিস্টোরিক্যাল প্রেগনেন্সি। সাইকোলজির ভাষায়, হিস্টোরিকাল প্রেগনেন্সির সহজ ব্যাখ্যা হলো মিথ্যা প্রেগনেন্সি। অর্থাৎ কিছু কিছু সময় নারী এমনকি পুরুষও ভাবতে শুরু করে তিনি আসলে গর্ভবতী হতে চলেছেন, যদিও বা বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি।
অর্থাৎ নিজের প্রতি ভ্রান্ত এক ধারণা রাখা। এই ধারণা মনের মধ্যে গড়ে ওঠার কিছু কারণ থাকে। বেশিরভাগ গবেষকরাই এই ব্যাপারে একমত, যেসব মানসিক রোগী হিস্টোরিকাল প্রেগনেন্সিতে ভোগেন, তারা পূর্বে কোন না কোন সময় চরম কোন মানসিক আঘাত পেয়েছেন।
গল্পের নামটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ
গল্পের নামটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ, মিসেস প্রহেলিকা। যদিও পুরো গল্পের কোথাও নারী চরিত্রের কোন স্বামী বা প্রাক্তন স্বামীর খোঁজ পাওয়া যায় না। আর তাই সেই ব্যাখ্যা এখানে আনলে, গল্পের মুল নারী চরিত্রের স্বপ্ন সম্পর্কিত থিওরিকে বাতিল বলে ধরে নেয়া যায়। কারণ তার নিজের বক্তব্য মতেই, তিনি একটি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে এমন মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যে, তিনি অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ খেয়ে কোমায় চলে যান। তার মানে বর্তমানে তার স্বপ্নের মধ্যে থাকার ভাবনাটা, খানিকটা হিস্টোরিকাল প্রেগনেন্সি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এছাড়াও পুরো সময়জুড়ে সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে কক্ষে থাকা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এটি আসলে স্বপ্ন নয়। যদি ধরেও নেই, আসলেই তিনি কোন স্বপ্ন দেখছেন না তবে এই ব্যাখ্যারও একটি সমস্যা আছে।আগেই বলেছি, গল্পের বিভিন্ন জায়গায় এমনকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা চোখে না পরলেও গল্পকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
তার মধ্যে একটি হলো, উল্টো সিগারেট। নারী চরিত্র স্বপ্ন দেখছেন, এবং সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন এটি তার স্বপ্নের অংশ নেয়। যেমন, তিনি একটি কাগজের টুকরোতে কিছু লিখে দেখান। এবং বলেন যদি স্বপ্নই হতো তবে কাগজের লেখাটি পড়া সম্ভব হতো না।
কারণ স্বপ্নে লেখা বা পড়া যায় না। তাছাড়া যদি এটি স্বপ্ন হয়, তবে এখানে থাকা সব কিছুই স্বপ্নের উপাদান মাত্র। স্বপ্নের বাইরে এই উপাদানগুলো স্বতন্ত্র কোন বৈশিষ্ট্য নেই। এটি প্রমান করার জন্য তিনি অচেনা একটি শব্দ বলেন- ‘এক্রোম্যাটোপসিয়া’, যে শব্দ নারী চরিত্রটি পূর্বে কখনই শোনেননি।
যদি তিনি স্বপ্নেই থাকেন তবে তার মাথায় নেই, এমন কোন শব্দ তো স্বপ্নে আসবার কথা নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যার সমস্যা আছে। হতে পারে, এই শব্দটি আসলে কোমায় থাকা অবস্থায় নারী চরিত্রটি আধোঘুমে নার্সদের মুখে শুনেছিলেন। এটি যেহেতু একটি চিকিৎসা বিদ্যার শব্দ, তাই নার্সিংহোমে এরকম শব্দ আধোঘুমে শুনতে পাওয়া অসম্ভবের কিছু নয়।
আধোঘুমে থাকলে এরকম অস্পষ্ট অনেক
তাছাড়া তিনি মাঝে মাঝেই কেমন অস্পষ্ট কথা শুনতে পান বলে দাবি করেন। আধোঘুমে থাকলে এরকম অস্পষ্ট অনেক শব্দ আমরা শুনি, সবগুলো ঠিকঠাক ধরতে না পারলেও আমরা বুঝি কোন না কোন স্থান থেকে কথাগুলো আসছে।এছাড়াও এই ব্যাখ্যাটিকে আরও জোড়ালো করা যায়। যেহেতু তিনি ঘুমে আছেন তাই এখানে সংগঠিত হওয়া সবকিছুই তার স্বপ্নের উপাদান।
অর্থাৎ তার পরিচিত সব বৈশিষ্ট্য এখানে ঘোরাফেরা করছে। পেছনে প্রচুর হুমায়ূন আহমেদের বই দেখা যায়। খানিকটা খেয়াল করলে, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস সমগ্র ইত্যাদিও শেলফে দেখতে পাওয়া যায়। গল্পের একদম শুরুতেই আমরা নারী চরিত্রটির মুখে শুনতে পাই, তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রচুর হুমায়ূন আহমেদ পড়েন।
গ্রামবাসীর কাছে এই শিশু যেন আল্লাহর রহমত
তবে কি এটাই তার স্বপ্নে প্রতিফলন ঘটছে? শুধু কি তাই, এখানে বেশ কয়েকবার সাইকিয়াট্রিস্টকে সিগারেট খেতে দেখা যায়। যাতে অন্তত এতটুকু বোঝা যায় যে, তিনি চেইন স্মোকার। অথচ সিগারেটগুলো খাওয়া হয় উল্টো করে। সম্ভবত, মুল নারী চরিত্র কখনও সিগারেট না খাওয়ায়, তিনি জানেনই সিগারেট কীভাবে ধরাতে হয়।
তাই স্বপ্নেও সেই জটিলতা থেকে গেছে।এই জটিলতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় গল্পের শেষ অংশে। যেটি দর্শকদের মনে প্রশ্নের দোলাচল তৈরি করে। এবং এই প্রশ্নে রেখে দাঁড়ায়, আসলে কি নারী চরিত্রটি স্বপ্ন দেখছে এটি প্রমানিত হয়? নাকি এটা উল্টো হয়ে আদতে সাইকিয়াট্রিস্টের স্বপ্ন? স্বপ্নের জটিলতার বাইরেও গভীর এক জীবনবোধও হাতছানি দেয় এই গল্পে।
আমাদের সামনে ঘটতে থাকা একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের জীবনের মোড় এমন জায়গায় এনে দাঁড়ায়, যা দেখে আমরা বাস্তব আর স্বপ্নকে আলাদা করতে পারি না। আমরা দেখতে পাই, দম্পতির রাত ন’টায় সিনেমা দেখতে যাওয়ার তাড়াহুড়ো, যার অন্য প্রান্তে জীবনের চরম সংকট নিয়ে বসে আছেন অন্য কেউ।
এই যে জীবনকে উদযাপন এবং জীবনকে উদযাপন করতে না পারা, এই দুটো দ্বন্দ্বের মুখোমুখি যোগাযোগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিবব্রত বর্মনের গল্প অবলম্বনে রবিউল আলম রবি মাত্র ২৩ মিনিটে দেখিয়েছেন, এ যেন এক আশ্চর্য দুনিয়া!নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং চঞ্চল চৌধুরীর অনবদ্য অভিনয়ে এই গল্প আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক আধ্যাত্মিক দুনিয়ায়।