তবে এই সাফল্য তাদের মধ্যে দুরত্বও এনে দিয়েছিলো। এমনিতেই বিবাহিত এই দুই তারকাকে নিয়ে গুঞ্জনের কোনো কমতি ছিলোনা। তবে পেশাগত সফলতা তাদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব নিয়ে আসে। কে বেশি জনপ্রিয় তা নিয়ে বিভক্তি তৈরী হয়। দুজনে একসাথে কাজ করা কমিয়ে দেন। তবে এই দুরত্ব আদতে তাদের দুজনের ক্যারিয়ারকে আরো সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে।
উত্তম ছাড়া সুচিত্রা বা সুচিত্রা ছাড়া উত্তম উপহার দিতে থাকেন একের পর এক সুপারহিট নান্দনিক সিনেমা। তবে নিজের প্রযোজনায় কালজয়ী ‘সপ্তপদী’ সিনেমার সেই বিখ্যাত রিনা ব্রাউনের চরিত্রে সুচিত্রা ছাড়া কাউকেই মনে ধরেনি উত্তমের। বন্ধু সুচিত্রাকে অনুরোধ করেন এই সিনেমায় আবার জুটি বাধার জন্য। সুচিত্রাও মান অভিমান ভুলে রাজি হলেন।
আবারো রুপালি পর্দায় জয়জয়কার সুচিত্রা
আর এই সিনেমার বদৌলতে আমরা পেলাম রোমান্টিক গানের ইতিহাসে সেই অমর গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। আবারো রুপালি পর্দায় জয়জয়কার সুচিত্রা আর উত্তমের। এরপর আর কোনদিন তাদের বন্ধুত্বে দুরত্ব আসেনি। উত্তমের জীবনে স্ত্রী হিসেবে গৌরি দেবী বা পরবর্তীতে সুপ্রিয়া দেবী পাকাপোক্ত আসনে বসলেও সুচিত্রা সেন সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে রয়ে গেলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
উত্তম কুমারের পেশাগত জীবনে একের পর এক সফলতা আসতে ছিলো কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। এরই মাঝে সুপ্রিয়া দেবীর সাথে তাকে জড়িয়ে গুঞ্জন সেই আগুনে ঘি ঢালছিলো।
কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন অরুণ কুমার
একটা সময় বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে যান উত্তম। নিজের বাড়ি ছেড়ে ময়রা স্ট্রিটে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে উঠেন। স্ত্রী গৌরী দেবীকে ছেড়ে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৮০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই ছিলেন তিনি। তবে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে থাকাকালীনও প্রায়ই চলে আসতেন ভবানীপুরের বাড়িতে। শুধুমাত্র মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার জন্য। মা চপলাদেবীর হাতের ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ির টানে ভোজনরসিক মহানায়ক শনি-রবিবার হলেই হাজির হতেন পৈত্রিক বাড়িতে।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘একটি রাত’, ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘জতুগৃহ’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘নায়ক’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’, ‘অগ্নিশ্বর’, ‘বিপাশা’, ‘জীবনতৃষা’, সাগরিকা’, ‘যদুবংশ’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘রাইকমল’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘শাপমোচন’, ‘স্ত্রী’, ‘মৌচাক’,’ধন্যি মেয়ে’, ‘কায়াহীনের কাহিনী’, ‘সন্নাসীরাজা’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’র মতো নান্দনিক সিনেমার মধ্য দিয়ে উত্তমকুমার বেচে রইবেন আমাদের মাঝে আরো অনন্তকাল একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তবে সমালোচকরা বলেন, উত্তম কুমারের জীবনের সেরা অভিনয় হলো সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘নায়ক’ এ।
সেখানে উত্তম দেখিয়ে দিয়েছিলেন
অবশ্য সেটা হবে নাই বা কেন। মহা-পরিচালকের সঙ্গে মহানায়কের যুগলবন্দি। সেখানে উত্তম দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর অভিনয়ের ক্ষমতা কতখানি। তবে সত্যজিতের সঙ্গে মাত্র দুইটি সিনেমা করেছিলেন উত্তম। নায়ক এবং চিড়িয়াখানা। তারপর তো অকালে চলে গেলেন। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে।
না হলে আমরা হয়তো আরও কিছু মাস্টারপিস উপহার পেতাম। উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি কয়েকটি হিন্দি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, দেশপ্রেমী ও মেরা করম মেরা ধরম অন্যতম। উত্তম কুমার পরিচালক হিসেবেও সফল ছিলেন।
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, বনপলাশীর পদাবলী, এবং শুধু একটি বছর সিনেমার সাফল্য প্রমাণ করেছিলো পরিচালক হিসেবেও তিনি অসাধারন। ১৯৬৭ সালে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও চিড়িয়াখানা সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন উত্তম কুমার (তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল ‘ভরত’)।
অবশ্য এর আগে ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত ‘হারানো সুর’ সিনেমাতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন সমগ্র ভারতজুড়ে। সেই বছর ‘হারানো সুর’ পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট। ইংরেজি উপন্যাস ‘রানডম হারভেস্ট’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়। প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার নিজেই।
ফ্যামিলি গেট-টুগেদারের একটা আলাদা গুরুত্ব চিরকালই ছিল তাঁর কাছে। তাঁর জীবদ্দশায় ছেলে বা নাতি-নাতনির জন্মদিন, কিছুই মিস করতেন না তিনি। তবে পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে কখনওই বাদ দিতেন না কাছের বন্ধু-বান্ধবদের। প্রতি বছর দোলের আসরে ভবানীপুরের বাড়িতে আসতেন টালিগঞ্জের একাধিক সেলেব্রিটি।
জনপ্রিয়তার কারণেই সে সময়ে পার্টি করতে বাইরে খুব একটা যেতেন না উত্তমকুমার। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতেই বসত আসর। বিশাল হলজুড়ে কার্পেট বিছানো থাকত আর মাটিতেই গদি-তাকিয়া সহযোগে করা হত বসার বন্দোবস্ত। অফুরন্ত খানাপিনার সঙ্গেই বিদেশি মিউজিকের তালে তালে কোমর দোলাতেন মহানায়ক।
প্রখ্যাত সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
প্রখ্যাত সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য তার একটি আর্টিকেলে লিখেছিলেন, ‘দেশভাগ থেকে নকশাল আন্দোলনের সময়কাল অবধি ধরলে সব বাঙালি চরিত্রেই উত্তম কুমার তার ছাপ রেখে গেছেন। ধনী, দরিদ্র, সরল, জটিল, ভাল, মন্দ, দূরের, কাছের, জয়ী, পরাস্ত, নায়ক, ভিলেন কোন চরিত্র তিনি করেননি। একজন অভিনেতার এতোটা শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতা বাংলা সিনেমায় আর আসবেনা।
পুরুষত্ব জাহির করা সেই কণ্ঠস্বর এবং আশ্চর্য লিপিং দক্ষতা মুগ্ধ করে রেখেছে আমাদের আজ অব্দি। হেমন্ত, মান্না, শ্যামল বা কিশোর কুমার যারই গান হোক উত্তম যেনো সবার কন্ঠকেই ধারন করেছেন অবলীলায়। উত্তম কুমারই বাংলা সিনেমার প্রথম নায়ক যিনি সিনেমার ভয়েসটা বুঝতে পারতেন।
অর্থাৎ এখানে যে মেলো ভয়েসের প্রয়োজন আছে, আর সেটাই যথাযথ সেটি উত্তম কুমারই প্রবর্তন করেন। থিয়েটার বা নাটকের মতো যে উচ্চস্বরে কথা বলার প্রয়োজন নেই তা বুঝিয়েছিলেন তিনি। উত্তম কুমার হচ্ছেন গড়পড়তা অবদমিত বাঙালির প্রতিনিধি। তিনি নিজের চারপাশে একটা রশ্মি তৈরি করতে পেরেছিলেন। তখনকার দিনে পেজ থ্রি ছিল না।
মিডিয়া সাপোর্ট ছিল না আজকের দিনের মতো। তা সত্ত্বেও উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন বা করছেন না তা নিয়ে চর্চা ছিল আপামর বাঙালির মধ্যে। উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ ছিল মানুষ হিসেবে তার সুনাম।
মানুষের কাছাকাছি থাকতে আর তাই
অভিনেতা হিসেবে দম্ভ-দর্প নয়, উত্তম কুমার ভালোবাসতেন মানুষের কাছাকাছি থাকতে আর তাই সাধারন মানুষও তাকে ভালোবাসতেন। সহকর্মীদের আর্থিক বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়াতেন নিঃস্বার্থভাবে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসের আজকের দিনে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন ‘মহানায়ক’। ক্ষণজন্মা এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র শিল্পর সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন ৩২ বছর।
তবুও যেনো আমাদের অতৃপ্তি মেটে না। উত্তমের এভাবে চলে যাওয়ায় শোকবিহ্বল সুচিত্রা সেনের কাছের কয়েকজনকে বলেছিলেন, “ও গ্রেট…তবু যেন মনে হয়, ওকে ঠিক মতো আবিষ্কার করা গেল না।” আড়াইশোর বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার।
বহুমুখী চরিত্রে নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন। নায়ক হিসাবে যখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা চূড়ায়, তখন খলনায়ক কিংবা বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে পিছুপা হননি। তাতেও তিনি দারুণভাবে সফল। তবে, কোথাও যেন এক ধারায় বয়েছে তাঁর সেলুলয়েডের জীবন। দেশ, কালের বেড়া ছাড়িয়ে ‘বিশ্বনায়ক’ হয়ে ওঠার খিদেয় একটা ভাল চরিত্র খুঁজে বেরিয়েছেন বার বার।
পরবর্তীকালে সুচিত্রার মতো সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “উত্তমের মতো কোনও নায়ক নেই। কেউ হবেও না। আশ্চর্য অভিনয়ের ক্ষমতা। ওর ক্ষমতা আছে দর্শক টেনে রাখার…”। যে দেশে সৎ অভিনেতার সদ্ব্যবহার করতে জানা লোকের এত অভাব, সেখানে এটাই স্বাভাবিক! তাই বলাই যায়, বাঙালির জীবনে ‘মহানায়ক’ হয়েও আজও অনাবিষ্কৃতই থেকে গেলেন উত্তম!