কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন অরুণ কুমার

১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন অরুণ কুমার। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় আর মা চপলা দেবী। নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভাব-অনটনের সংসার তাদের। তখন অরুন কুমার বাবা-মায়ের সাথে গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের তাদের ছোট্ট বাড়িতেই থাকেন। বাবার সামান্য বেতনে সংসার চলছে না। উপায় না দেখে উপার্জনের জন্য কোমড় বেধে নেমে পড়লেন বাড়ির বড় ছেলে অরুণ।

কিংবদন্তী হিসেবে উত্তম কুমার অমর

পড়াশোনার পাশাপাশি গানের শিক্ষকতা শুরু করলেন। তখনও কেউ ভাবতেও পারেননি কিছুদিন পরেই এই পরিশ্রমী যুবক বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ খেতাব পেতে যাচ্ছেন। হ্যা ঠিক ধরেছেন অরুন কুমার নামের সেই ছেলেটি সিনেমায় এসে হয়ে গেলেন উত্তম কুমার।

Capture3gvthg

এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত একজন কিংবদন্তী হিসেবে উত্তম কুমার অমর হয়ে রয়ে গেলেন আমাদের হৃদয়ে। আজ তার ৪১ তম প্রয়ান দিবসে এই বিশেষ ফিচার। পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য শিক্ষকতা করার সময়েই গান শেখাতেন তিনি। এমনভাবেই বিখ্যাত গাঙ্গুলী বাড়ির মেয়ে গৌরী দেবীকে গান শেখানোর দায়িত্ব পেলেন। বেতনও বেশ ভালো, সেই সময়ে মাসে ৭৫ টাকা।

আগেই কিছুটা চেনাজানা থাকলেও গানের শিক্ষকতা করতে গিয়ে কাছে এলেন অরুন-গৌরী। বিত্তশালী গৌরির পরিবার বাধা দিয়েছিলেন, নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেও মেয়ের কঠিন পণ দেখে একটা সময় নরম হলেন তারা এবং ১৯৫০ সালের ১লা জুন সাত পাকে বাধা পড়েই অরুণের ঘরে এলেন গৌরী দেবী।

গানের শিক্ষকতা শুরু

বিয়ের আগেই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছেন অরুন। ছোটবেলা থেকেই অরুণ প্রচন্ড থিয়েটার অনুরাগী ছিলেন। সাথে যাত্রার ভক্তও ছিলেন তিনি। এভাবেই রুপালি পর্দায় অভিনয়ের ঝোঁকটা ক্রমেই বেড়ে চলেছিলো। ১৯৪৭ সালে হিন্দি সিনেমা ‘মায়াডোর’এ অভিনয়ের সুযোগ মিললো ৷ মাত্র পাঁচ সিকিতে দৈনিক বেতন চুক্তিতে ওই সিনেমাতে অভিনয় করলেন অরুণ।

কিন্তু ‘মায়াডোর’ মুক্তি পেল না। ৪৮ সালে পেলেন আরেকটি সুযোগ, ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমাতে সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক অসিতবরণের অল্প বয়সের চরিত্রে। কিন্তু দর্শকমনে তেমন দাগ কাটতে পারলেন না অরুণ। পরের সিনেমা ‘কামনা’। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটাও সুপার ফ্লপ।

পরের দুই সিনেমা ‘মর্যাদা’ ও ‘ওরে যাত্রী’ বক্সঅফিসে ফ্লপ হিসেবে নাম লেখালো। তারপর মুক্তি পেলো ‘সহযাত্রী’ এবং কিছুদিন পরে ‘নষ্টনীড়’। এবার তার অভিনয় কিছুটা নজর কাড়লেও সিনেমা ফ্লপ তাই ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকালেন না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে একের পর এক সিনেমা ফ্লপ করছে কিন্তু অরুন কুমার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন ৷ বিষয়টি সেই সময় ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই ভালভাবে নিল না। আড়ালে-আবডালে তাঁকে ডাকা শুরু হল ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ বা ‘এফএমজি’ বলে। এই নামটা বেশ ভালোভাবেই রটে গেলে সিনেমাপাড়ায়। খবরের পাতায় এফএমজি ঘিরে খবরও ছাপা হল। কিন্তু দমে যাননি অরুন কুমার।

প্রখ্যাত নির্মাতা সরোজ মুখোপাধ্যায়ের

তিনি বাজি ধরেছিলেন নিজের উপর যে, তাকে সফল হতেই হবে। তবে অসফলতার ধারাবাহিকতা তখনো চলছিল। প্রখ্যাত নির্মাতা সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘মর্যাদা’ সিনেমাতে নায়ক হিসেবে তার নাম পাল্টে দেয়া হলো অরূপ কুমার। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না কিছুই। তবে এই ‘সহযাত্রী’ সিনেমাতে অভিনয় করছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের সঙ্গে।

শুটিংয়ের ফাঁকে এক আড্ডায় পাহাড়ি সান্যাল হঠাৎ বলে বসলেন-’তুমি অরুণ নও হে, তুমি যে উত্তম, উত্তম কুমার।’ তার পরামর্শে নাম পাল্টে হয়ে গেলেন উত্তম কুমার। এই নাম নিয়েও ১৯৫১ সালে ‘সঞ্জীবনী’ সিনেমা ফ্লপ হল। ‘বসু পরিবার’ সিনেমাতে ঠিক নায়কের ভূমিকায় নয়, ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে।

এই সিনেমাটি বেশ ভাল ব্যবসা করার পাশাপাশি নিজের অভিনয়ের জন্য প্রথমবার প্রশংসিত হলেন উত্তম কুমার। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল নির্মলদের প্রেম এবং কমেডি ঘরনার সিনেমা ‘সাড়ে ৭৪’। মুক্তির পর চারদিকে একটাই কথা যে, এক নতুন জুটি এসেছে সিনেমার পর্দায়। তবে বয়স্করা মজেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাদের দাবি, হিরো-হিরোইন তো তুলসী-মলিনা।

নায়িকার সাথে জুটি

নতুন জুটি তো সাইড রোলে। এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সিনেমাটি বক্স অফিস চমকে দেয়া ব্যবসা করলো ৷ টানা আট সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে চললো এই সিনেমা ৷ সাদা-কালো ‘সাড়ে ৭৪’ এর মাধ্যমে যে নতুন জুটির ইনিংস শুরু হয়েছিল তাতেই রঙিন ইতিহাস লেখা হলো।

প্রথমবারের মতো উত্তম কুমার পেলেন কালজয়ী সাফল্য। এই সাফল্যের উপর ভর দিয়ে যে যুগের শুরু হয়েছিলো টানা তিন দশক ধরে সেই যুগের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছিলো। সাফল্যের এই যাত্রায় উপমহাদেশের দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে পৌঁছে গেলেন এক অনন্য উচ্চতায়।

এখনো সেই অনাবিল হাসি, অকৃত্রিম চাহনি আর অভিনয় গুণে কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসে আজও বাঙালির চেতনায় উত্তম কুমার যেনো খুব জীবন্ত। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয়ের আগে উত্তম কুমার তার ক্যারিয়ারের ছয় বছরে নয়টি সিনেমাতে অভিনয় করেন। এই সিনেমাগুলোর ৯ নায়িকার মধ্যে আটজনই ছিলেন বয়সে উত্তমের বড়।

মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ছবি রায়

ছোট ছিলেন একমাত্র সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। মায়া মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ছবি রায়, মনীষা দেবী, করবী গুপ্ত, ভারতী দেবী, সনিন্দা দেবী, সন্ধ্যা রানী ও মঞ্জু দে- আটজনকেই উত্তম ‘দিদি’বলে ডাকতেন। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের অনেকেই মনে করেন, বয়সে বড় নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করায় উত্তমের শুরুর কেরিয়ারে প্রভাব ফেলে।

Capturevgtt

দর্শকেরা অল্প বয়সী নায়কের সাথে একটু বেশি বয়সী নায়িকাদের গ্রহন করেন নি। তবে ‘সাড়ে ৭৪’ সিনেমার সাফল্যের আসল চমক বোঝা গেলো পরের বছর। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল উত্তম অভিনীত ১৪টি সিনেমা, তার মধ্যে সাতটিই সুচিত্রার সঙ্গে জুটি বেঁধে।

ইন্ডাস্ট্রিতে তখন উত্তম-সুচিত্রা সিনেমা হিট করার মূলমন্ত্র। জুটি হিসেবে তাদের যাত্রা যে এক সোনালী ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে তা মনে হয় তারা নিজেরাও ভাবেননি। প্রথম সিনেমা ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ’ সিনেমাতে অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার।

প্রথম সিনেমাতে মায়া মুখোপাধ্যায় থেকে সর্বশেষ ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় নিজের ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ৪৬ জন নায়িকার সাথে জুটি বেধেছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ‘ওরা থাকে ওধারে’ সিনেমা দিয়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটি পাকাপাকিভাবে দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নেয়।

তবে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার অভাবনীয় সাফল্য তাদের সর্বকালের সেরা জুটির স্বীকৃতি এনে দেয়। ১৯৫৩ সালে যে সাফল্যমণ্ডিত যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ সিনেমা দিয়ে সেই যাত্রা শেষ হয়। এই ২২ বছরে মুক্তি পেয়েছে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সর্বমোট ৩১টি সিনেমা মুক্তি পায়। প্রতিটা সিনেমাই তাদের জুটির মুকুটে একেকটি সোনার পালক জুড়ে দিয়েছিলো। বাঙালির চোখে আজো তারাই একমাত্র জুটি যাদের আবেদন এখনো ফুরায়নি, আর ফুরাবে বলে মনেও হয়না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *