থ্রিলার দেখে প্রথমেই ডেভিড লিঞ্চের পরাবাস্তবতা

জাপানি আর্টহাউজ নির্মাতা সুকামোতোর সাইকোসেক্সুয়াল থ্রিলার দেখে প্রথমেই ডেভিড লিঞ্চের পরাবাস্তবতা ও ক্রোনেনবার্গের বডি হররের কথা মনে পড়ে। ভায়োলেন্ট হার্ড হিটিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মুভির জন্য পরিচিত এই লোকের ৭ম ফিল্মে ইরটিক কামনাবাসনা, দাম্পত্যে ব্যক্তিগত সেক্সুয়াল প্র্যাকটিসকেও তুলে ধরেছেন,

যার মূলে রয়েছে ৩টা চরিত্র – এক ক্যারিয়ারিস্ট মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের কর্মী, তার শুচিবায়ুগ্রস্ত স্বামী ও অচেনা কেউ, যে তাদের স্টক করছে।শুরুতেই নীল মনক্রোমের কালার প্যালেট একধরণের দুঃস্বপ্নের অনুভূতি দেয়, পুরা সিনেমাটা দেখার অভিজ্ঞতার সাথে স্বপ্নের তুলনা করাই যায়।

জীবনের সাথে ছিনিমিনি খেলছে অসুস্থ

ডিস্টার্বিং ভিজুয়াল, নয়েজ, বৃষ্টিস্নাত শহরে অন্তর্মুখী কারো গোপন জীবনের সাথে ছিনিমিনি খেলছে অসুস্থ কোন অস্তিত্ব। কেন এবং কীভাবে সে এসব করছে, সেটাই রহস্য।  মানসিক এই অত্যাচার তাদের ব্যক্তিসত্বা ও দাম্পত্য জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে সেটাই সিনেমা।

থ্রিলার দেখে প্রথমেই ডেভিড লিঞ্চের পরাবাস্তবতা

ইরটিক এই থ্রিলার শুধু তাদের জন্য যারা পরাবাস্তব ডিস্টোপিয়ান অভিজ্ঞতা নিতে স্বাধীনচিত্ত। সব শেষে মূল চরিত্রে অভিনেত্রী কুরাসাওয়ার অন্যধরণের সৌন্দর্য, পরিচালক সুকামোতোর পাগলা ভিশন, স্টকারের ভূমিকায় যিনি নিজেই অভিনয় করেছেন এবং মুভির নীল মনোক্রোম ট্রিটমেন্ট মাথায় থাকবে।

এক কথায় অ্যাডভেঞ্চারাস অদ্ভুতুড়ে সিনেমাখোরদের জন্য। ছবিটি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে kinematrix অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল। আমার গ্রেডিংহলিউড যখন প্রতিভাবানদের নিয়ে বহু আগে থেকেই বায়োপিক (জন ন্যাশ, A Beautiful Mind [২০০১], হাইপেশিয়া, Agora [২০০৯], মেরি ক্যুরি, Radioactive [২০১৯], নিকোলা টেসলা, Tesla [২০২০]) নির্মাণ করে আসছে তখন বলিউড-ই বা তাদের নিজস্ব ভূমিতে জন্মগ্রহণ করা রত্নদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবে কেন? ‘মানব কম্পিউটার’ হিসেবে খ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ শকুন্তলা দেবীকে নিয়ে অনু মেনন গত বছর তৈরি করেছেন ‘শকুন্তলা দেবী’ মুভিটি।

ছবির নাম ভূমিকায় রয়েছেন বিদ্যা বালান, তার স্বামীর চরিত্রে যিশু সেনগুপ্ত, কন্যার চরিত্রে সানিয়া মালহোত্রা। মুভিটিতে শকুন্তলা চরিত্রটি একরৈখিক নয়, গণিতে তার অসামান্য প্রতিভার পাশাপাশি, পিতামাতা ও স্বামী-সন্তানের সাথে মানসিক ও ব্যক্তিত্বের টানাপোড়েন সহ জীবনের বিভিন্ন সময়ের খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে ধরা হয়েছে,

শকুন্তলা দেবীর ব্যক্তিগত জীবনের

অবশ্য শুরুতেই পরিচালক এক বিশাল ডিসক্লেইমার দিয়ে মুভিটি যে ঐতিহাসিক সত্যের আনুপূর্বিক বিবরণ নয় সে তথ্য দর্শকদের জানিয়ে রেখেছেন।আর দশটা টিপিক্যাল বলিউডি চলচিত্রের যে গঠন-বৈশিষ্ট্য, কাহিনীর নির্মাণ ও বিস্তার- ‘শকুন্তলা দেবী’ তার থেকে ব্যতিক্রমী কিছু নয়।

মুভির সত্তর ভাগ জায়গা জুড়েই শকুন্তলা দেবীর ব্যক্তিগত জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা, ঝগড়াঝাঁটি, হাসিকান্না প্রভৃতি আবেগসঞ্চাত দৃশ্যের উপস্থিতি রয়েছে। মুভির শেষটায় গিয়ে মা-মেয়ের অশ্রুভেজা মিলন শতভাগ উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

মুভিতে শকুন্তলা দেবীর গণিতে পারঙ্গমতা দেখানো হয়েছে তার জন্মগত প্রতিভা হিসেবে, কোনো পরিশ্রমসাধ্য চর্চার ফলাফল হিসেবে নয়, যদিও পারদর্শিতা বাড়ানোর জন্য তাকে পরবর্তীতে অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এখানে তার গণিতবিদ পরিচয়ের পাশাপাশি যে দিকটি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো তিনি জ্যোতিষচর্চায় পারদর্শী একজন নারী, এককথায় যাকে বলে জ্যোতিষী।

জ্যোতিষশাস্ত্রেও পারদর্শিতা অর্জন করেছেন

এবং তিনি যে জ্যোতিষী এটা তার গণিতজ্ঞ পরিচয়ের থেকে স্বাধীন স্বতন্ত্র কিছু নয়। গণিতে পারঙ্গম হিসেবেই তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রেও পারদর্শিতা অর্জন করেছেন এমনটাই বোঝানো হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলার বিভিন্ন শাখার ওপর ভর করে জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো অপবিজ্ঞানও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শক্ত আসন গেড়ে বসেছে।

পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও জ্যোতিষী, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, ভাগ্যগণক থেকে শুরু করে তুকতাক, ঝাঁড়ফুকওয়ালা বহু কামেল লোকজনের দেখা পাওয়া যায়। আমাদের উপমহাদেশের মতো বিজ্ঞান ও পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে বিভিন্ন ঘরানার জ্যোতিষচর্চার চিত্র আরো প্রকট।

আর ভারত তো মনে হয় জ্যোতিষী, গণকঠাকুর থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার অলৌকিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাট্য প্রভৃতি মাধ্যমেও জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষ সমর্থনের রমরমা অবস্থা দেখা যায়।এবার সামান্য আলাপ করা যাক ভারতের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত Prabir Ghosh-এর ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থ সিরিজের তৃতীয় খণ্ডের দশম অধ্যায়ের “চ্যালেঞ্জের মুখে রণে ভঙ্গ দিলেন মানবী কম্পিউটার ও জ্যোতিষ সম্রাজ্ঞী শকুন্তলা দেবী” শীর্ষক অংশটি নিয়ে।

সেখানে তিনি তথ্যপ্রমাণ সহকারে উল্লেখ

সেখানে তিনি তথ্যপ্রমাণ সহকারে উল্লেখ করেছেন ১৯৮৭ সালে তার জ্যোতিষশাস্ত্রের অভ্রান্ততার চ্যালেঞ্জ কোলকাতায় ‘গ্রেট ইস্টার্ন’ হোটেলে থাকাকালীন শকুন্তলা দেবী তো গ্রহণ করেন-ই নি উপরন্তু প্রবীর ঘোষের উপস্থিত থাকা অবস্থায় হোটেলের পেছনের গেট দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি হোটেলে বিল পর্যন্ত পরিশোধ করেন নি।

প্রবীরের ভাষায় “না, হোটেলের সামনের পথ ধরে শকুন্তলা দেবী বের হন নি। সাংবাদিকদের চোখ এড়াতে পিছনের পথ দিয়ে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বেচারা, তাড়াহুড়োয় হোটেলের বিল মিটিয়ে সহকারিণীটিকে নিয়ে যাওয়ারও সময় সুযোগ পান নি।

আর সেই পালানোর সময় পিছনের দরজায় নজর রাখা চিত্র-সাংবাদিক কল্যাণ চক্রবর্তীর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে প্রবীর ঘোষের চ্যালেঞ্জ যে তিনি আর কখনোই গ্রহণ করেন নি, সে কথারও উল্লেখ বইটিতে রয়েছে। শকুন্তলা দেবীকে নিয়ে লেখা পুরো অংশটিই বেশ উপভোগ্য, যার বর্ণনা এখানে প্রদান করা সম্ভব না।

প্রবীর ঘোষ আরো লিখেছেন

প্রবীর ঘোষ আরো লিখেছেন: “শকুন্তলা দেবী কোনও অঙ্ক কষার অনুষ্ঠানে প্রথমেই ঘোষণা করতেন যে, তিনি শুধু অ্যারিথমেটিক কষবেন। ট্রিগনোমেট্রি, অ্যালজেবরা বা ওই জাতীয় কিছু কষবেন না। লগ টেবিল ব্যবহার করতে হয় এমন কোনও প্রবলেমও কষে দেখাবেন না।

দেখাবেন যোগ, গুণ, ভাগ, মূলনির্ণয়, কোনও বছরের তারিখের বার নির্ণয় ইত্যাদি” শকুন্তলা দেবী কি ফর্মুলা ধরে অংক কষেন জানি না। তবে আমি একটা ফর্মূলার কথা লিখেছিলাম যার সাহায্যে মুখে মুখেই শকুন্তলা দেবীর মতোই অংক কষে ফেলা যায়। এবং অভ্যেস করলে অংক কষার সময়ও অবশ্যই কমবে।” [পৃষ্ঠা: ২৬৫]। এখানে বলে রাখি, বিসিএস প্রস্তুতির সময়ে আমিও মুখে মুখে দ্রুত অংক কষার কিছু কৌশল শিখে নিয়েছিলাম।

সেগুলো অবশ্য খুব বড় কিছু নয় এবং পরবর্তীতে তার চর্চা না থাকায় এখন ভুলে গেছি। তবে চমক-লাগানো গণিতজ্ঞ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগোলে অবশ্যই চর্চার মাধ্যমে শুধু যে এগুলো মনে রাখা যায় তা-ই নয়, পারদর্শিতার ধার বাড়ানো যায় এবং আরো উন্নত স্তরে অবশ্যই পৌঁছানো যায়।অনু মেনন এই জীবন কাহিনীভিত্তিক মুভিতে এ বিষয়গুলোর ওপর সামান্য আলোকপাত করলে হয়তো আরো ভালো করতেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *