ডিজ এন্ড জেন্টলমেন- ফারুকীর হাতে যেন মিডাস টাচ! দর্শক হিসেবে আমার সমস্যা হয়ে গেছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাজ আমার পছন্দ কিন্তু দেখার আগে একটু ডিফেন্স মোডে থাকি। বারবার মনে হয় যে নাও ভালো লাগতে পারে। আশেপাশের রিভিউ, রিঅ্যাকশনও হয়তো ইফেক্ট ফেলে। তবে আমার বরাবরই ফারুকীর কাজ পছন্দ হয়।
আশপাশের সেসব মতামত কাজ দেখার পর আর আমার কাছে ভ্যালু করে না। লেডিজ এন্ড জেন্টলমেন দেখার পরেও একদম আগের অনুভূতিটাই হল। ফারুকী এখানেও তার হাত দিয়ে সোনা ফলিয়েছেন, মিডাস স্পর্শে অনেকগুলো দিক তুলে এনেছেন যেটা হয়তো অন্যরা পারতো না।
যেটা হয়তো কোন গল্পকারই শুরুতে
আর এতেই মুগ্ধ করেছে লেডিস এন্ড জেন্টলমেন।লেডিজ এন্ড জেন্টলমেন শুরু করার পর আমি সাবিলার জগতে চলে গিয়েছিলাম। সংস্কৃতি কেন্দ্র, সাবিলার বাসা ফারুকী অবস্থানগত পরিবর্তন খুব কম করেছেন হয়তো দর্শককে থিতু করার জন্যই। ফারুকী গল্পের চেয়ে সবসময় চরিত্রে বেশি জোর দেন। গল্প তিনি চরিত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী আগান। তাই গল্পকে একটা সময় পর সবসময় সাইডলাইন হয়ে যেতে হয়।
লেডিজ এন্ড জেন্টলমেনের গল্পের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে।গল্প যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখান থেকে অনেক পাঁক ঘুরে অন্য এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে। যেটা হয়তো কোন গল্পকারই শুরুতে ভাবতেন না।
গ্রামবাসীর কাছে এই শিশু যেন আল্লাহর রহমত
ফারুকী ভেবেছেন কারণ চরিত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি গল্পের সেসব গলিঘুপচিতে ঢুকেছেন। কখনো সাবিলা তাকে নিয়ে গেছে সেখানে, কখনো মিজু। তিনি নিজে যেতে চান নি, চরিত্ররাই তাকে নিয়ে গেছে।চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে ফারুকী সাবিলা, মিজু, খায়রুল আলমকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এক্সপ্লোর করেছেন। এজন্য কিছুটা খাপছাড়া লেগেছে।
মিজুর অস্তিত্বই যেমন ছিল না শুরুতে অথচ শুরু থেকেই তাকে স্ট্যাবলিশ করা যেত ছোট দু-একটা সিন দিয়ে। সাবিলার স্বামীর চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাই, মোস্তফা মনওয়ারকে দু-একটা সিনে আরেকটু স্ট্যাবলিশ করা যেত, যেটার প্রয়োজন শেষে গিয়ে মনে হয়। সাবিলা আর মিজুর চরিত্রায়ন নিখুঁত।
এই দুই চরিত্রে তাসনিয়া ফারিণ আর হাসান মাসুদ অভিনয়ও করেছেন চুটিয়ে। তাসনিয়া ফারিণকে অসম্ভব স্নিগ্ধ লেগেছে পুরো সিরিজজুড়ে। তার অদ্ভুত সাবলীল অভিনয় বারবার তিশাকেই মনে করিয়েছে। হাসান মাসুদকে অনেকদিন পর ফুল ফর্মে দেখে ভালো লেগেছে। আফজাল হোসেনকে ভিন্ন শেডে দেখে অস্বস্তি লেগেছে আর এই অস্বস্তিটাই আসলে তার অভিনয় দক্ষতা।
মারিয়া নূর ভালো ছিলেন। মামুনুর রশীদ আর তাসনিয়া ফারিণের বাবা-মেয়ের রসায়ন সিরিজের হাইলাইট ছিল। এই সিরিজের কিছু আইকনিক সিন তাদের দুজনকে ঘিরেই। মামুনুর রশীদ আর তাসনিয়া ফারিণ একে অপরকে কমপ্লিমেন্ট করেছেন দুর্দান্ত অভিনয়ে। বাকিরা চলনসই কাজ করেছেন। এতো বড় স্টারকাস্টের দরকার ছিল না। চঞ্চল কেন এলেন আর কেন গেলেন এখনো বুঝতে পারি নি।
সাবিলার মতো চরিত্র ওয়েব সিরিজে
সাবিলার মতো চরিত্র ওয়েব সিরিজে এর আগে আসে নি। সাবিলা আমাদেরই মেয়ে, বোন, স্ত্রী, বন্ধু। যার প্রতিটা দিন সমাজের অসঙ্গতিগুলোর সাথে যুদ্ধ করে কাটে। আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। কিন্তু সাবিলা প্রতিবাদী হয়েছে, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। আমরা পাশে দাঁড়াই বা না দাঁড়াই, সাবিলারা এই যুদ্ধ করে যাবে। সাবিলাদের মন থেকে স্যালুট।নুরুল আলম আতিক – এর ‘ডুব সাঁতার’ (২০১০) সম্পর্কে শুরু থেকেই জানতাম।
কিন্তু কোন না কোন কারনে ছবিটা এতো দিনেও দেখা হয়নি। অবশেষে চরকিতে পেয়ে দেখে ফেললাম জয়া আহসান অভিনীত চমৎকার এই ছবিটি। ছবিটা নিয়ে কখনোই খুব একটা প্রত্যাশা ছিলো না আমার। শুরু থেকেই এটাকে ডিজিটাল ছবি, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ইত্যাদীর তকমা দেয়ায় খাঁটি সিনেমাপ্রেমী হিসেবে এটার প্রতি তাই আমার আগ্রহ্ না জাগাটাই ছিলো স্বাভাবিক।
অথচ দেখতে গিয়ে বুঝলাম সত্যিই ভুল ইম্প্রেশন তৈরী হয়েছিলো ছবিটার প্রতি। এটা দেড় ঘন্টা দৈর্ঘ্যের দারুণ এক সিনেমা। একদম শুরুর দৃশ্যটা থেকেই ছবিটার প্রতি মুগ্ধতা তৈরী হয়। ছবিটার গল্প বেশ সিনেম্যাটিক। পারিবারিক একটি গল্প যা শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক একটা প্রেমের গল্পে পরিণত হয়। ছবির ক্লাইম্যাক্সটাও সিনেম্যাটিক ড্রামার স্বাদ দেয়।
নূরুল আলম আতিক- এর স্বতন্ত্র ধারার নির্মাণ স্টাইলের প্রশংসা না করলেই নয়। যদিও প্রেমটাকে তিনি খুব বেশী সুব্দরভাবে দেখাননি তবে পারিবারিক আবহ্ দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে কিছু কিছু শট। বিশেষ করে রেল লাইনের শটগুলো অসম্ভব সুন্দর। জয়া আহসানের কল্পনায় তার ছোট বেলার কিছু দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর। যেমন, চলন্ত ট্রেনের নীচে রাজহাঁসের দৃশ্যটা বা এরকম আরো বেশ কিছু দৃশ্য।
আসলে ডিজিটাল ক্যামেরায় চিত্রায়িত হওয়া স্বত্বেও গোটা ছবিটাই দেখতে বেশ লেগেছে।অর্থাৎ ছবির চিত্রায়ন চমৎকার লেগেছে। সবচেয়ে বেশী ভাল লেগেছে জয়া আহসানের পারফর্মেন্স। দারুণ ন্যাচারাল সে। বাংলাদেশের ছবিতে জয়াকে এতোটা চমৎকারভাবে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। যদিও তার প্রেমিক চরিত্রের ছেলেটাকে তেমন ভাল লাগেনি।
আসলে চরিত্রটাই ততোটা সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেনি। জয়া হুট করে কেন এক নেশা আসক্ত ছেলের প্রেমে পড়লো সেটা স্পষ্ট না। জয়ার মায়ের চরিত্রে ওয়াহিদা মল্লিক জলি এবং তার দুই ভাইয়ের চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন সবাই ভাল করেছেন। ভাত চোর ছেলেটাও তার চরিত্রে মানানসই। আর সারপ্রাইজিং ছিলো জয়ার ছোট ভাইয়ের মেয়ে বন্ধু চরিত্রে তিন্নি দত্ত এবং স্বাগতার উপস্থিতি। বিশেষ করে বখাটে চরিত্রে তিন্নি বেশ চমকে দিয়েছে।
এছাড়া স্বাধীন খসরুকে ছোট্ট একটা
এছাড়া স্বাধীন খসরুকে ছোট্ট একটা চরিত্রে দেখতে পেয়ে ভাল লেগেছে। এটা ঠিক ফর্মাল রিভিউ না। জাস্ট ছবিটা দেখার পর নিজের অনুভুতিগুলো শেয়ার করছি। তাই এখানে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো না। তবে আমার মনে হয়েছে নেশা আসক্ত একটা ছেলের সাথে জয়া আহসানের প্রেমে জড়ানোটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য ভাবে আসেনি পর্দায়।
একটু তাড়াহুড়ো ছিলো যেন। ফলে তাদের প্রেমের গল্পের সাথে সেভাবে কানেক্ট হতে পারিনি। অথচ এটা হতে পারতো বাংলা সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজিক প্রেমের গল্প। গল্পের শেষটা তেমনি হৃদয়স্পর্শী। কিন্তু প্রেমের গল্পটা শুরুতে ভালভাবে বিল্ড আপ না হওয়ায় শেষটা অতোটা ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারেনি। আর শেষার্ধ খানিকটা স্লো এবং রিপিটিটিভ লেগেছে।ছবিটার দুর্বলতা বলতে এইটুকুই।তারপরও নুরুল আলম আতিকের নির্মাণ স্টাইল দেখে আমি বেশ মুগ্ধ।
ক্যান্টোনিজ সিনেমা ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন
আমার মনে হয়েছে তিনি একজন আন্ডাররেটেড নির্মাতা। ২০১০ সালে অর্থাৎ বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বাজে সময়টায় তিনি যে ধারার কাজ দেখিয়েছেন সত্যিই তার প্রশংসা না করে পারছি না। আর জয়া আহসানের অভিনয় দেখে মনে হয়েছে সত্যিই বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ড্রাষ্ট্রি তার সৌন্দর্য এবং প্রতিভাকে ব্যবহার করতে পারেনি।
না হয় ডুব সাঁতারে সে যে অভিনয় দেখেয়েছে তাতে তাকে নিয়ে মাতামাতি হওয়ার কথা ছিলো। সত্যিই এবার বুঝলাম কেন পশ্চিম বাঙলার নির্মাতারা জয়াকে নিয়ে কাজ করতে এতো আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো। যারা জয়াকে পছন্দ করেন কিংবা যারা করেন না দুই পক্ষই ডুব সাঁতার দেখুন। বুঝতে পারবেন জয়া কোন মাপের অভিনেত্রী।
গল্পের মাঝপথে জনরা চেঞ্জ অনেকেরই বিরক্ত লেগেছে, তবে আমি ইনজয় করেছি কারণ স্লো হয়ে গিয়েছিল পেস। অনেকগুলো আন্ডারলাইনড ম্যাসেজ ছিল পুরো সিরিজজুড়েই, সেগুলো খুবই ইম্পরট্যান্ট। নারীদের নিয়ে এতো দারুণ ম্যাসেজ, এতো দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ডায়লগে মুড়িয়ে এর আগে ওয়েব সিরিজে কেউ নিয়ে আসে নি।
ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর মিউজিক দুটোই টপ ক্লাস। মাশার গান দারুণভাবে মানিয়ে গেছে সাবিলার জার্নির সাথে। প্রোডাকশন খুবই ভালো ছিল। টেকনিক্যাল দিক থেকে মাস্টারক্লাস লেডিজ এন্ড জেন্টলমেন। গল্প ও চরিত্রায়নের দিক থেকেও ভালো। ফারুকী বলে এক্সপেক্টেশন আরেকটু বেশি ছিল। আরেকটু ছোট হতে পারতো কয়েকটা এপিসোড। এডিট আরও ক্রিস্প হতে পারতো। তবে এই অভিযোগগুলো খুবই কম, মুগ্ধতাই বেশি। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা সাবিলায়।