উচ্চশিক্ষার জন্য কখনোই আমার পছন্দের জায়গা ছিল না স্লোভেনিয়া, এমনকি এখানে আসার আগে এ দেশকে নিয়ে আমার মধ্যে কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমাকে জেতে হয় স্লোভেনিয়ায়। ২০১৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার জন্য দুবার শিক্ষার্থী ভিসায় আবেদন করেছিলাম, দুর্ভাগ্যবশত আমার ভিসার আবেদন গৃহীত হয়নি।
আমার বন্ধু অ্যালেক্সকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে তাঁর দেশকে আমি কতটা ভালোবাসি। কেন উইলিয়ামসনের কথাও তাঁকে বারবার বললাম যে তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেটার, অ্যালেক্স অবশ্য খুব একটা ক্রিকেটপাগল নন আমাদের মতো। বেশ কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে গল্প করলাম, একসঙ্গে ছবি তুললাম। অ্যালেক্সকে বললাম যে আমি নিউজিল্যান্ডের অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলতে চাই। আমার কথা শুনে প্রিয় বন্ধু অ্যালেক্স হাসলেন, পরে অবশ্য তিনি আমাকে তাঁদের ঘরানার ইংরেজি শেখাতে রাজি হয়েছেন।
বলকান অঞ্চলের রন্ধনশিল্পে প্রিজরেনের আলাদা নামডাক রয়েছে। কোফতা ও কাবাব থেকে শুরু করে মাংস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন গ্রিলজাতীয় খাবার রান্নায় প্রিজরেনের হেঁশেল ব্যাপকভাবে সমাদৃত। প্রিজরেন শহরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সিচালককে বলেছিলাম আমাকে এমন কোনো একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে, যেখানকার খাবার সত্যিকার অর্থে বিশেষ অসাধারন ছিল।
ট্যাক্সিচালক আমার কথা শুনে আমাকে এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন এবং সেখানকার কোফতার স্বাদ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। এ রেস্টুরেন্ট শহরের প্রধান সড়ক বেশ ভেতরে এবং আয়তনে যে খুব বড় সেটিও বলব না। তবে মানুষের ভিড় ছিল উপচে পড়ার মতো। দুই ইউরোর বিনিময়ে এ রেস্তোরাঁ চেখে দেখা কোফতার স্বাদ সত্যিকার অর্থে ছিল অতুলনীয়।
লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস কিংবা ইস্তাম্বুলের মতো প্রিজরেন কোনো বিশেষ শহর নয়। এ শহরটি এতটাই ছোট যে হেঁটে কয়েক ঘণ্টায় পুরো শহর ঘুরে দেখা সম্ভব। তবে এ ছোট এবং সাধারণ শহরটি দিন শেষে আমার মাঝে অবর্ণনীয় সুখানুভূতির জন্ম দিয়েছে।
কসোভো ভ্রমণের তৃতীয় তথা শেষ দিনটি পেয়ার জন্য বরাদ্দ রাখলাম। পেয়াতে অবশ্য আমি একা ছিলাম না, গাজমেন্দও সেদিন আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন। বিয়ার উৎপাদনের জন্য এ শহর বেশ প্রসিদ্ধ। আলবেনিয়া, কসোভো ও উত্তর মেসিডোনিয়ায় পেয়ার বিয়ার বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া সার্বিয়ানদের কাছে প্রিজরেনের মতো পেয়াও পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত।
তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী পেয়ায় অবস্থিত সার্বিয়ান অর্থোডক্স মনাস্টেরিটি সবচেয়ে পুরোনো অর্থোডক্স মনাস্টেরির মধ্যে একটি, যেটি আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। ইউনেসকো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটগুলোর মধ্যে এ মনাস্টেরিটি অন্যতম, যদিও সার্বিয়া এবং কসোভোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে বর্তমানে এটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে দর্শনার্থীরা চাইলে মনাস্টেরিটি ঘুরে দেখতে পারেন।
মনাস্টেরির চারপাশে সব সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল থাকে। ভেতরে প্রবেশ করতে হলে আইডি কার্ড কিংবা পাসপোর্টসহযোগে তাঁদের থেকে আলাদাভাবে অনুমতি নিতে হয়। তবে মনাস্টেরির এলাকাটি সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ, যদিও আমি প্রচলিত নির্দেশনার বাইরে গিয়ে একান্ত গোপনে কিছু ছবি তুলেছিলাম।
প্রিস্টিনা ও প্রিজরেনের তুলনায় পেয়া বেশ দরিদ্র এবং অনেকাংশে কাদাটে ও অপরিচ্ছন্ন। পেয়ার সেন্ট্রাল বাসস্টেশনে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল এ বুঝি গুলিস্তানে ফিরে এলাম। বৃষ্টির দিন হওয়ায় আশপাশের রাস্তায় পানি জমে ছিল।
পেয়ার পুরোনো অংশের নাম বাজার, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচলিত গতানুগতিক ধারার বাজারের সঙ্গে পেয়ার এ বাজারের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কেননা এ অংশে কেবল ট্র্যাডিশনাল বিভিন্ন জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায়। সস্তায় কেনাকাটা করার মতো দোকানও রয়েছে এ বাজারে। অবশ্য পেয়ার এ বাজার আয়তনের দিক থেকে খুবই ছোট।
বাজারের পথ ধরে কয়েক মিনিট হাঁটতে ওসমানী শাসনামলের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত বায়রাকলি মসজিদের দেখা পেলাম। পুরো বাজারটি গড়ে উঠেছে এ মসজিদকে ঘিরে। ১৪৭১ সালে নির্মিত মসজিদটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসোলিনির সেনাবাহিনীর আক্রমণে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধে সার্বিয়ার সেনারা এ মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।
পেয়ার মূল সৌন্দর্য রুগা পর্বতকে ঘিরে, তবে এ পর্বতের সত্যিকারের সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে শহর থেকে অনেকটা দূরে যেতে হবে। এ জন্য ট্যাক্সির প্রয়োজন। ৩০ ইউরোর বিনিময়ে আমরা ট্যাক্সি ভাড়া নিয়েছিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম ছিল শাবান, শাবানের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছিল যে তিনি আমাদের রুগা পর্বতের পাশাপাশি সার্বিয়ান অর্থোডক্স মনাস্টেরি ঘুরে দেখাবেন।
পেয়ার মূল শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে আমরা রুগা পর্বতের দিকে অগ্রসর হতে না হতে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানি খুঁজে পেলাম। পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা রাস্তার দুই ধারের দৃশ্য ছিল অসাধারণ। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে এখনো যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে হলিউডের বিভিন্ন সিনেমা থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছি, এখানে আসার পর মনে হচ্ছিল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বুঝি পেয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। পথিমধ্যে শাবান এক জায়গায় তাঁর ট্যাক্সি থামালেন এবং আমাদের একটি ওয়াটারফল দেখালেন।
ওই ওয়াটারফলের সামনে থেকে কয়েকটি ছবি নিলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পেয়া বিস্ট্রিকা নদীর গতিপথের সৌন্দর্য দেখার অনুভূতিও ছিল এ ট্যুরের আরও একটি অর্জন। বলকান পর্বতমালার অসাধারণ রূপকে আরও একবার কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো পেয়ার বদলৌতে। রুগাসহ আশপাশের প্রতিটি পর্বত ছিল চোখজুড়ানো সৌন্দর্যে ঠাসা।
শীতের দিন হওয়ায় পাহাড়ের উপরিভাগে তুষার জমে ছিল। সেই সঙ্গে বিকেলের মিষ্টি রোদ পাহাড়ের উপরিভাগকে ঝলমলে করে রেখেছিল। ক্ষণিক সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল রূপকথার রাজকুমারী স্নো হোয়াইট যেনও পাশের কোনো পাহাড়ে রৌদ্রস্নান করছেন। পশ্চিমের মিডিয়ায় সচরাচর যাকে সানবাথ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
এ ছিল মোটামুটিভাবে কসোভো ভ্রমণের গল্প। এটা ঠিক যে এর আগে এ দেশ সম্পর্কে আমার মাঝে এর আগে খুব একটা ভালো ধারণা ছিল না। সার্বিয়া এবং মেসিডোনিয়া তো বটেই, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর অধিবাসীরা কসোভো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তবে এ দেশটিতে আসার পর আমি সত্যিকার অর্থে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।
সত্যি কথা বলতে, এ দেশের মানুষ ভীষণভাবে অতিথিপরায়ণ এবং এ ধরনের অতিথিপরায়ণতা সচরাচর ইউরোপের অন্যান্য দেশে দেখা যায় না। তাই যখন কসোভো ছেড়ে আবারও স্লোভেনিয়ায় ফিরে আসছিলাম, বারবার মনের মধ্যে একধরনের শূন্যতাবোধ সৃষ্টি হচ্ছিল। ইস্কান্দার এবং গাজমেন্দ দুজনই আমাকে বিদায় জানাতে প্রিস্টিনার সেন্ট্রাল বাসস্টেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন।
কোনোভাবে তাঁদের বিদায় জানাতে ইচ্ছা করছিল না। কসোভোতে আসার পর কেন জানি মনে হচ্ছিল এ দেশটিতে আমি আমার আরেকটি পরিবারকে খুঁজে পেয়েছি। হয়তোবা সেখানকার মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ অতিথিপরায়ণতা এক দিন আবারও আমাকে কসোভোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।