আমাদের দেশের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক তিনি। ঔপন্যাসিক হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরবর্তী সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসবে তার নাম উচ্চারিত হয় দুই বাংলায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঙালির মনের মনিকোঠায় যিনি নাড়া দিয়েছেন তার সহজ আর সুন্দর লেখনী দিয়ে তিনি হুমায়ূন আহমেদ।
অসংখ্যা জনপ্রিয় উপন্যাস, গল্প, নাটক তিনি লিখেছেন এবং সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো সাহিত্যের সব শাখায় তিনি অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। গল্প/উপন্যাস বা নাটক অথবা বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদ উপহার দিয়েছে কালজয়ী অনেকগুলো কাজ।
সাধারন মানুষকে বই পড়তে শিখিয়েছেন
সত্তর, আশি এবং নব্বই দশকে তিনি সাধারন মানুষকে বই পড়তে শিখিয়েছেন বা বই পড়ার মজাটা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের একটা পুরো জেনারেশন তার লেখা বইয়ের মাধ্যমে পড়ার আগ্রহ তৈরী করতে পেরেছে বললে কথাটি মিথ্যা হবেনা। লেখক পরিচয়ের পাশাপাশি নির্মাতা হিসেবেও কিছু কালজয়ী চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন তিনি।
আজ এই ফিচারটি নন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তবে তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে নয়, তার চলচ্চিত্র মাধ্যমে বিচরন নিয়ে। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা বা পরিচালক হিসেবে নয় বরং ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে হুমায়ূন আহমেদের অভিষেক হয়েছিল।
১৯৯২ সালে পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান হুমায়ূন আহমেদের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মান করেন। এই গল্পটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৭৩ সালে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন নাজমা আনোয়ার, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, আবুল হায়াত, চম্পা, আজিজুল হাকিম এবং বিশেষ একটি চরিত্রে জাফর ইকবাল। উপন্যাসের গল্পের সাথে মিল রেখে সিনেমাটি নির্মান করা হয়েছিলো। মুক্তির পর সাধারন দর্শক এবং সমালোচকদের মন জয় করে নিয়েছিলো সিনেমাটি।
হুমায়ূন আহমেদের কাছে বই লিখে জমানো
প্রতিটা চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অসাধারন অভিনয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সংলাপ এবং নির্মানের মুন্সিয়ানা সব মিলিয়ে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ওই বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মোট চারটি ক্যাটাগরীতে পুরষ্কার পায় ‘শঙ্খনীল কারাগার’।
- কিন্তু তিনি কি জানতেন এটিই হবে তার
- প্রভোকেটিভ অঁতর’ আবেল ফেরারার সিনেমা
- মাদার তেরেসার মত ভালো মানুষগুলো ও জাহান্নামী
- কুরআনী চিকিৎসা চুল পরা, আঁচিল, ব্রণ, দাগ দূর করার উপায়
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক এর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে ‘শঙ্খনীল কারাগার’। দুই বছর গ্যাপ দিয়ে ১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। নাটক নির্মানের অভিজ্ঞতা থাকলেও চলচ্চিত্র নির্মান করতে এসে তিনি বুঝলেন যে, এটি সহজ কাজ নয়। ‘আগুনের পরশমণি’ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র এবং এটা সরকারি অনুদানে তৈরি হয়েছিলো।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই সিনেমা নির্মান করতে প্রায় ৪০ লাখ টাকা প্রয়োজন ছিলো, হুমায়ূন আহমেদের কাছে বই লিখে জমানো সর্বসাকুল্যে ২ লাখ টাকা ছিল। এমন অবস্থায় এক সকালে কাছের মানুষ এবং ওই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা অাসাদ্দুজামান নূরকে নিয়ে তার পরিচিত বিত্তবানদের কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু সেভাবে সাড়া পাননি।
কিন্তু মনস্থির করে ফেলেছেন যে এই সিনেমাটি তিনি বানাবেনই তাই পরবর্তীতে তিনি তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করলেন এবং উনাকে অনেক কষ্টে বোঝালেন যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বানানো একটা সিনেমা বানাতে সরকারের সাহায্য করা উচিত।
কাজের মেয়ে বিন্দির চরিত্রে হোসনে
তথ্যমন্ত্রী আগুনের পরশমনি মূল বইয়ের একটা কপি পাঠিয়ে দিতে বলে উনাকে বিদায় দিলেন। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখা বইয়ের একটা কপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন পর সকালে নিউজপেপারে ঘোষনা হলো যে, সিনেমা নির্মাণে সরকার ২৫ লাখ টাকা করে অনুদান প্রথা আবার চালু করেছে এবং সেই বছরের নির্বাচিত ৩টি সিনেমার মাঝে একটি হলো ‘আগুনের পরশমণি’।
সেই সময়টাই দেশের অবস্থা এমন ছিল যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাটাও ছিলো নিষিদ্ধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর নাম থাকবেনা তা কেমন করে হয়! অনেক ভেবে হুমায়ূন আহমেদ একটা বুদ্ধি বের করলেন।
সিনেমার শুরুটা ছিলো পরিবারের কর্তা মতিন সাহেব বারান্দায় বসে রেডিওতে বিবিসি শুনছেন। সেই দৃশ্যে বিবিসি এর বদলে একাত্তরে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষনের অংশবিশেষ জুড়ে দেয়া হয়। পরে সেন্সরবোর্ড ব্যাপারটি ঠিকই ধরে ফেলে তবে হুমায়ূন আহমেদ তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহই সেন্সর ছাড়পত্র করিয়ে নেন।
‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তিযোদ্ধা বদি’র চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদ্দুজামান নূর। বাড়ির কর্তা চরিত্রে আবুল হায়াত, কর্ত্রীর চরিত্রে ডলি জহুর, বড় মেয়ের রাত্রির চরিত্রে প্রথমবার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত, ছোট মেয়ে অপলার চরিত্রে শীলা আহমেদ।
কর্ত্রীর চরিত্রে ডলি জহুর
এছাড়া দোকানদার চরিত্রে সালেহ আহমেদ, কাজের মেয়ে বিন্দির চরিত্রে হোসনে আরা পুতুল, বদির মামার চরিত্রে মোজাম্মেল হোসেন, বদির মায়ের চরিত্রে দিলারা জামান ছোট্ট চরিত্রেও নিজেদের উজার করে দিয়েছিলেন। ফলাফল প্রথম চলচ্চিত্রেই বাজিমাত করেন হুমায়ূন আহমেদ।
মোট আটটি ক্যাটাগরীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে আগুনের পরশমনি। আগুনের পরশমণি’ র ব্যাপক সাফল্যের পরে তার পরিচালনায় দ্বিতীয় সিনেমা ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায়। সামজিক রোমান্টিক ঘরানা এই সিনেমায় অভিনয় করেন গোলাম মোস্তফা, জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, শাওন, মুক্তি, আনোয়ারা, সালেহ আহমেদ, ডা.এজাজ, শামীমা নাজনীন সহ আরো অনেকে ।
শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিটিতে ফোক গানের যে অসামান্য ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, তা বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখা গেছে। আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, পুবালী বাতাসে, শুয়া চান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি উকিল মুন্সীর কালজয়ী এই গানগুলো দরদ ভরা কন্ঠে অসাধারণ গায়কী দিয়ে নতুনভাবে বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন বারী সিদ্দিকী। উল্লেখ্য এই সিনেমার মাধ্যমেই গীতিকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘একটা ছিলো সোনার কন্যা’ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। অসাধারন এই গানটি বাংলা চলচ্চিত্রের গানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গানের স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রয়াত গায়ক সুবীর নন্দী এই গানটি গেয়ে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেন।
গ্রামবাংলার মানুষের জীবন, গান, সুখ-দুঃখের গল্প সব মিলিয়ে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্র জনপ্রিয় এবং আলোচিত একটি সিনেমা। এই সিনেমাটি সেরা অভিনেতা, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা, গায়ক, সেরা সংগীত পরিচালক, গীতিকার, চিত্রগ্রাহক এবং শব্দ গ্রাহক হিসেবে সাতটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘দুই দুয়ারী’ মুক্তি পায় ২০০০ সালে।
এই সিনেমাটি তার আগের দুই সিনেমার থেকে পুরোপুরি ভিন্নধর্মী গল্প নিয়ে নির্মান করা হয়েছিলো। সিনেমার কাহিনী আবর্তিত হয় একটি পরিবারে একজন রহস্য মানবের হঠাৎ আগমন এবং তার প্রভাবে বিভিন্ন রকম কর্মকান্ড নিয়ে ওই পরিবারের সদস্যদের ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে।
তার আগের দুটো চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রে টিভি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করলেও এই সিনেমাতে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ধারার অন্যতম জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজ অভিনয় করেন মূল চরিত্র। অন্য প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করছেন শাওন ও মাহফুজ আহমেদ। এছাড়া মাসুদ আলী খান, নাসিমা খান, ডা. এজাজ, শবনম পারভীন, আমিরুল হক চৌধুরী এবং শামীমা নাজনীন।
আমিরুল হক চৌধুরী এবং শামীমা নাজনীন
দুই দুয়ারী’ সিনেমার সংগীত রচনা করেন হুমায়ুন আহমেদ নিজেই, এবং সংগীত পরিচালনা করেন মকসুদ জামিল মিন্টু। ‘মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপ’ বা ‘বর্ষার প্রথম দিনে’ এর মতো অসাধারন শ্রুতিমধুর গান পেয়েছি আমরা এই সিনেমার মাধ্যমে। রিয়াজ এবং সাবিনা ইয়াসমিন এই সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা এবং সেরা গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান।
২০০৩ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের চতুর্থ সিনেমা ‘চন্দ্রকথা’। আসাদুজ্জামান নূর, আহমেদ রুবেল, ফেরদৌস, শাওন, চম্পা, স্বাধীন খসরু অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি ব্যবসা সফল হবার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসা পায়। এটি তাঁর নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নিজ চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান নুহাশ চলচ্চিত্র এর ব্যানারে নির্মাণ করেন। গ্রামের এক প্রভাবশালী জমিদার, তার বিশ্বস্ত চাকর, গ্রামের গরীব কিন্তু সুন্দরী এক মেয়ের অসহায়ত্ব এবং সমাজ ব্যবস্থা নিয়েই সিনেমার গল্প।
‘চন্দ্রকথা’ সিনেমায় অসাধারন অভিনয়ের জন্য আহমদ রুবেল এবং শাওন ৬ষ্ঠ মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচনা পুরস্কার শাখায় যথাক্রমে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেত্রী বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন। এই সিনেমার ‘ও আমার উড়াল পংখী রে’ এবং ‘চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরন করে’ গান দুইটি অসাধারন জনপ্রিয়তা পায়।